নোয়াখালী জেলা প্রতিনিধি >>> মনের মাধুরী মিশিয়ে নিপুন হাতে মৃৎশিল্পীরা ফুটিয়ে তুলছেন সকল দেবদেবীকে। দেবীদুর্গার প্রতিমা ছাড়াও শিব, কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী, অসুর সহ অন্যান্য প্রতিমা তৈরির কাজ করছেন মৃৎশিল্পীরা।
আর মাত্র কয়েক দিন পর সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দূর্গা পুজা। হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘরে-ঘরে দেবীদুর্গার আগমনী বার্তা যেন কড়া নাড়ছে। এই উৎসবকে পূর্ণাঙ্গরূপে সাজিয়ে তুলতে নোয়াখালীর পূজা মণ্ডপগুলোতে প্রতিমা তৈরিতে ব্যস্ত মৃতশিল্পীরা।
মৃৎশিল্পীদের নিপুন হাতের ছোয়ায় ইতিমধ্যে মাটির কাজ শেষ করে চলছে রঙ তুলির কাজ। শিল্পীর রঙ তুলির আঁচড়ে গড়ে তোলা হচ্ছে দশভূজা দেবীদুর্গাসহ বিভিন্ন দেবদেবীর প্রতিমূর্তী।
সনাতনধর্মাবলম্বীদের কাছে দেবীদুর্গা শক্তি ও সুন্দরের প্রতীক। প্রতি বছর অশুরের বিনাশ করে মা দেবী দুর্গা এই ধরাধামে আবির্ভূত হয়। তাই সনাতন ধর্মাবলম্বীরা মনে করেন, সমাজ থেকে অন্যায়-অবিচার গ্লানি দূর করার জন্যই এই পূজার আয়োজন করা হয়।
নোয়াখালী জেলা পূজা উদযাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক রতন কৃষ্ণ পাল বলেন, প্রতি বছরের ন্যায় আসছে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় আনন্দ মুখর উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। শরতের কাশফুল জানান দিচ্ছে শারদীয় দুর্গোৎসবের আগমনী বার্তা। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালনের জন্যই দেবী দুর্গার স্বর্গ থেকে আগমন ঘটেছিল মর্ত্যলোকে।
শরতের নির্মল প্রকৃতির নীল আকাঁশ, প্রকৃতির সবুজের সমারোহে সাঁদা সাঁদা কাঁশফুলে, শিউলির মন মাতানো সুগন্ধী, রাশি রাশি বাহারি রঙ্গের জবা যেন মা দুর্গার অপরুপ এক সাজ। দুর্গাপূজাকে ঘিরে নোয়াখালীতে প্রতিমা তৈরিতে ব্যস্তসময় পার করছেন মৃৎশিল্পীরা। ভক্তদের হৃদয় ছুঁতে শিল্পীদের প্রতিযোগিতা চলছে মণ্ডপে মণ্ডপে। সময় যত ঘনিয়ে আসছে ততই বাড়ছে মৃৎ শিল্পীদের ব্যস্ততা।
সরেজমিনে দেখা যায়, নোয়াখালীর বিভিন্ন পূজামণ্ডপে প্রতিমা তৈরির কাজ চলছে। এতে ব্যস্ততা বেড়েছে প্রতিমা শিল্পীদের। দ্রুত কাজ সম্পন্ন করতে রাত-দিন পরিশ্রম করছেন তারা। কাদা-মাটি, বাঁশ, খড়, সুতলি দিয়ে শৈল্পিক ছোঁয়ায় গড়ে তোলা হচ্ছে প্রতিমা। প্রতিমা তৈরীর কাজ শেষের পথে। এখন চলছে ডেকোরেশন, আলোকসজ্জা, প্যান্ডেল সহ অন্যান্য কাজগুলো।
সবুজ চন্দ্র দাস বলেন, আশা করছি এবছর আরও সুন্দরভাবে দুর্গাপূজার উৎসব উদযাপন হবে। আসন্ন শারদীয় উৎসবে মেতে উঠার অপেক্ষায় সনাতন ধর্মালম্বী সম্প্রদায়ের মানুষেরা। শাস্ত্রমতে, এবার দেবীদুর্গা ঘোটকে আগমন করে পালকিতে চড়ে কৈলাশে ফিরে যাবেন।
নোয়াখালীর কবিরহাট উপজেলার নরোত্তম পুর ইউনিয়নের পশুরামপুর গ্রামের মৃৎশিল্পী নয়ন আচার্য্য বলেন, আমার পিতা গত ৫০ বছর যাবত প্রতিমা তৈরী করছেন। আমিও ছোটবেলা থেকে কাদামাটি ও রঙতুলির সঙ্গে বেড়ে ওঠায় এখন আমিও প্রতিমা তৈরী করছি।
নয়ন বলেন, আমি সারা বছর প্রতিমা তৈরি করি। প্রতি বছর ৫০ থেকে ৬০ সেট প্রতিমা তৈরির অর্ডার আসে। এবার ও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। ইতোমধ্যে ১০ সেট প্রতিমা ডেলিভারি দিয়েছি।
তিনি বলেন, প্রতি সেট প্রতিমা তৈরিতে ব্যয় হয় প্রায় ৩০ থেকে ৯০ হাজার টাকা। সে হিসেবে বিক্রি করা হয়। তিনি আরও বলেন, আমরা নোয়াখালী ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে প্রতিমা তৈরীর অর্ডার পাই। এ বছর নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষীপুর ও কুমিল্লা জেলা থেকে সর্বমোট ৫৬ সেট প্রতিমার অর্ডার পেয়েছি। এক প্রশ্নের জবাবে নয়ন বলেন, আমার শ্রী শ্রী জগন্নাথ মৃৎশিল্পালয়ে আমি সহ ৬জন কারিগর কাজ করেন। আমরা মাটি, সিমেন্ট ও পাথরের প্রতিমা এবং ভাসকর্যও তৈরী করি।
উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানা যায়, এ বছর কবিরহাট উপজেলায় ১৮টি মন্ডপে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে শারদীয় দূর্গা পুজা।
উপজেলার বিভিন্ন পূজা মন্ডপ ঘুরে দেখা যায়, পুজা উৎসবকে পরিপূর্ণ রূপ দিতে মন্দির গুলোতে চলছে সাজসজ্জার প্রস্তুতি। ইতি মধ্যে বেশির ভাগ মন্ডপের প্রতিমা তৈরীর কাজ প্রায় শেষ। বেশীরভাগ মন্দিরে শুরু চলছে রং তুলির কাজ। স্থানীয় শিল্পী ছাড়াও বিভিন্ন স্থান থেকে আগত শিল্পীরা এখানে এসে প্রতিমা তৈরি ও রং তুলির কাজ করছেন।
এ বিষয়ে কবিরহাট পূজা উদযাপন কমিটির সভাপতি অর্জুন ভৌমিক জানান, আমাদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসবকে সার্থক করতে শিশু-কিশোর, নারী-পুরুষসহ সব বয়সী মানুষ এখন শুধু প্রহর গুনছে। বর্তমান সরকার সার্বিকভাবে সহযোগীতার পাশাপাশি আর্থিক ভাবে ও সহযোগীতা করছেন। এবং এবারের পূজায় তাদের আনন্দ ও বেশি হবে।
সাধারণ সম্পাদক প্রদেশ পাল জানান, ১৩ অক্টোবর মহালয়ার মধ্যে দিয়ে শারদীয় দুর্গোৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়বে। ১৯ অক্টোবর মহা পঞ্চানী, ২০ অক্টোবর ষষ্ঠী, ২১ অক্টোবর সপ্তমী, ২২ অক্টোবর অষ্টমী, ২৩ অক্টোবর নবমী, ২৪ অক্টোবর বিজয়া দশমীর মধ্যে দিয়ে ৫ দিনব্যাপী হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গা পূজার পরিসমাপ্তি ঘটবে।
কবিরহাট থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, শান্তিপূর্ণ ভাবে হিন্দু ধর্মালম্বীদের প্রধান উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা অনুষ্ঠান সম্পন্ন করার লক্ষে আইন শৃংখলা বাহিনী সজাগ দৃষ্টি রাখছে। আইন শৃংখলা বাহিনীর পক্ষ থেকে তিন স্তরের নিরাপত্তার ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়েছে এবং থানার উপ-পরিদর্শক (এস আই) ও সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) দের বিভিন্ন মণ্ডপের দায়িত্ব দিয়ে নিয়মিত টহল দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি সবকটি পূজা মন্ডপ গোয়েন্দা নজরদারিতে থাকবে। অন্যান্য বছরের চাইতে এবার জোরালো প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে।